দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের সংগঠন সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের (এসসিবিএ) পুরো নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল দুই সপ্তাহেও ঘোষণা না হওয়াকে ‘লজ্জাজনক’ মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সম্পাদক পদে পুনরায় ভোট গণনা চেয়ে আবেদন এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির আহ্বায়কের পদত্যাগ করার মতো ঘটনা নজিরবিহীন বলেও মন্তব্য তাদের।
এই নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা ও জটিলতায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন প্রবীণ ও সাধারণ আইনজীবীরা। তারা বলছেন, এমন ঘটনা দুঃখজনক। আগে দুই পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে পুনরায় ভোট গণণার ঘটনার নজির থাকলেও ফলাফল ঘোষণা বন্ধ থাকেনি। তারা চান, যত দ্রুত সম্ভব ফলাফল ঘোষণা করা হোক।
গত ১৫-১৬ মার্চ সভাপতি ও সম্পাদকসহ ১৪টি কার্যনির্বাহী পদের জন্য সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির (২০২২-২০২৩) বার্ষিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত ‘বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ’ এবং বিএনপি সমর্থিত ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য’ প্যানেলের মধ্যে।
দুই পক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অতীতে দুই পক্ষের সম্মতিতে পুনরায় ভোট গণনার নজির থাকলেও নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির আহ্বায়কের পদত্যাগ সমিতির ইতিহাসে কখনো ঘটেনি।
সুপ্রীম কোর্টের সাবেক সভাপতি, জেষ্ঠ্য আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সুপ্রীম কোর্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এখানে যারা প্রাকটিস করেন তারা সবাই সম্মানিত মানুষ। কিন্তু এবার নির্বাচন নিয়ে যা হলো এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এতে আদালতেরও ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। এখনো সময় আছে কে জিতলো, কে হারলো সেটা বড় করে না দেখে ফলাফল যা, ঠিক সেটিই ঘোষণা করা।’
এর আগে কখনো নির্বাচনের ফল আটকে রাখার ঘটনা ঘটেছে কি-না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কিছু মানুষের একগুয়েমির কারণে এমনটা হয়েছে। সাময়িক হইচই হলেও কখনো ফলাফল আটকে থাকেনি। নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো শক্তি আছে।’
সাবেক আইনমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি বিব্রতবোধ করেন। ঢাকা টাইমসকে প্রবীণ এই আইনজীবী বলেন, ‘এটা লজ্জাজনক। ভেরি আনফরচুনেট। সুপ্রিম কোর্ট সর্বোচ্চ আদালত। আমরাও এখানে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছি। নানা সময়ে ভোটের সময় অনেক সমস্যা হয়েছে কিন্তু এমনটা কোনোদিন ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। দায়িত্বশীলদের উচিত বিষয়টির দ্রুত সমাধান করা।’ যে কারণে আটকে আছে ফলাফল ঘোষণা
আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভোটের পরে ১৮ মার্চ ফলাফল গণনার একপর্যায়ে অনিয়মের অভিযোগ তুলে নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির আহ্বায়কের কাছে আবেদন দেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সাদা প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী আবদুন নূর। তিনি রাত ১২টার দিকে সম্পাদক পদে পুনরায় ভোট গণনা চেয়ে আবেদন করেন।
বিভিন্ন টেবিল থেকে আসা প্রার্থীদের ভোট একত্র করে তখন যোগ শুরুর কাজ চলছিল। অনানুষ্ঠানিক ফলাফলে বিএনপি-সমর্থিত নীল প্যানেলের প্রার্থী মো. রুহুল কুদ্দুস (বর্তমান সম্পাদক) এগিয়ে ছিলেন।
আবদুন নূরের আবেদনের ভিত্তিতে সম্পাদক পদে পুনরায় ভোট গণনা করে ফলাফল ঘোষণার দাবি তোলেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সাদা প্যানেলের সমর্থকেরা। অন্যদিকে ফলাফল ঘোষণার দাবি তোলেন বিএনপি-সমর্থিত নীল প্যানেলের সমর্থকেরাও। এ নিয়ে সেদিন মধ্যরাত পর্যন্ত পক্ষে-বিপক্ষে চলে হইচই ও হট্টগোল। আর সেসময় অনেকে আহ্বায়ক এ ওয়াই মসিউজ্জামানের পদত্যাগের দাবি তোলেন।
এক পর্যায়ে অনেকটা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত উপকমিটির আহ্বায়ক এ ওয়াই মসিউজ্জামান ও অন্য সদস্যরা। পরে সম্পাদক পদে পুনরায় ভোট গণনা চেয়ে করা আবেদন দুই পক্ষের উপস্থিতিতে পরের দিন নিষ্পত্তি করার কথা বলেন আহ্বায়ক।
কিন্তু স্বাস্থ্যগত কারণ উল্লেখ করে ওই রাতেই সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটি বরাবরে পদত্যাগপত্র দেন। এতে সৃষ্টি হয় নতুন সমস্যা। স্বাস্থ্যগত কারণে পদত্যাগ করার কথা বললেও ‘লাঞ্ছিত’ করার কারণে তিনি সরে দাঁড়িয়েছেন বলে অভিযোগ তোলেন আইনজীবীদের কেউ কেউ।
পদত্যাগের পর মসিউজ্জামান জানান, সমিতির গঠনতন্ত্রে পুনরায় ভোট গণনার বিধান নেই। তিনি স্বাস্থ্যগত কারণে পদত্যাগ করেছেন। এখন কার্যনির্বাহী কমিটি পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।
এদিকে ওই ঘটনার পর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ সমর্থিত প্যানেলের নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত কমিটির আহ্বায়ক মোমতাজউদ্দিন আহমদ মেহেদী সংবাদ সম্মেলন করে পুনরায় সম্পাদক পদে ভোট করে সমস্যা সমাধানের অনুরোধ জানান। অন্যথায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বর্তমান কমিটিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন।
উভয় প্যানেলের যুক্ত আইনজীবীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সমিতির ১৪টি পদের মধ্যে সভাপতি, সহসভাপতির দুটি পদ, সদস্যের তিনটি পদসহ ছয়টি পদে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের (সাদা প্যানেল) প্রার্থীরা ভোট গণনায় এগিয়ে ছিলেন।
অন্যদিকে সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ, সহসম্পাদকের দুটি পদ, সদস্যের চারটি পদসহ মোট আটটি পদে এগিয়ে ছিলেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেলের (নীল প্যানেল) প্রার্থীরা। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এতদিনেও ফলাফল ঘোষণা না হওয়ায় বিব্রতকর অবস্থায় আছি। এখানে তো পুরো এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের। দ্রুত তারা পদক্ষেপ নেবেন এটা আশা করছি।’
আটকে থাকা ফলসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে সমিতির সভাপতির দায়িত্বে থাকা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এ আমিন উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তা সম্ভব হয়নি।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল ঢাকাটাইমসকে বলেন, যে ঘটনাটি ঘটেছে এটি খুবই বিব্রতকর। সুষ্ঠু, সুন্দর ভোটের পর সব প্রার্থী যখন ভোট নিয়ে সন্তুষ্ট তখন একজন প্রার্থী এটা মানছেন না। পরে যা ঘটেছে তাও দুঃখজনক। সাবেক নেতৃবৃন্দ, সিনিয়র আইনজীবীরাও বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। আশা করি শিগগিরই এই জটিলতার অবসান হবে।